আমাদের সর্বশেষ সংবাদ

আবাসন ভাবনা

Apr 17, 2019
আবাসন ভাবনা

আবাসন ভাবনা
প্রকৌশলী মোঃ শাহীন ইসলাম খান
প্রধান প্রকৌশলী
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ


নগর পরিকল্পনা, নগরায়ণ, ভূমির ব্যবহার, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্টের বিষয়গুলো চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে সম্প্রতি। অথচ কিছুদিন আগেও এ বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে তেমন করে কেউ ভাবেনি। আবাসিক এলাকাতে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বিষয়টি নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা। পরিচিত জনরা যখনই প্রকৌশলী, স্থপতি বা ডেভলপার পরিচয় পায় মন্তব্যের আক্রমণ শুরু করে ‘আপনার তো শহরটা শেষ করে দিচ্ছেন বিল্ডিং নির্মান করে’। মন্তব্যকারী একবার ভেবে দেখেন না যে, কি বিশাল কর্মযজ্ঞ করে এতগুলো মানুষকে একজায়গায় থাকার উপযুক্ত আধুনিক পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছেন উদ্যোক্তাগণ। সময়ের বিবর্তনে মানুষের চাহিদা কতটা বেড়েছে কোন ধারণাই হয়তো নেই মন্তব্যকারীর।


এ প্রসঙ্গে বলা যায় একই ভবনে রয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বাণিজ্যিক অফিস ও প্রতিষ্ঠান আছে সুপার সপ, বিপনিবিতান, বিউটি পারলার, ব্যায়ামাগার, স্টেশনারী দোকান, সেলুন, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, আছে গ্রোসারী সপ এবং ভবনের উপরে আবাসিক বসতি। ভেবে দেখুন এই আবাসিক বাসিন্দাদের কতটুকু সুবিধা। বাজার শপিং করার জন্য দূরে যেতে হয় না। শপিংমল, ব্যায়ামাগার, সব রয়েছে হাতের মুঠোয়, সময়ের অপচয় হচ্ছে না। রাস্তার যানজট আমাদের অনেকটা সময় নিয়ে নিচ্ছে। এখানে তা অনেকটা সাশ্রয় হচ্ছে।
বিশুদ্ধ আবাসিক এলাকা ধারণাটা এখন সেকেলে হিসেবে বিবেচিত। আগে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একক কার্যভিত্তিক এলাকা গড়ে তোলার মাধ্যমে নগর পরিকল্পনায় করা হতো। আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, শপিংমল, বাজার, শিল্প, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক ভবনকে প্রতিটি এলাকা ভিত্তিক আলাদা করে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন করা হতো। এ প্রসঙ্গে ঢাকা শহরের কথা চিন্তা করা যায়। আবাসিক এলাকা হিসাবে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, শপিং করার জন্য নিউ মার্কেট, চাদনি চক, গাউছিয়া, নীলক্ষেত মার্কেট, শিক্ষা ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল, বিভিন্ন স্কুলকলেজে গুলো নির্দিষ্ট জায়গায়। ফলে মানুষের আবাসিক এলাকা তার কর্মক্ষেত্র সামাজিক দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাজের জায়গা থেকে আলাদা হতে থাকে। প্রতিদিনের কাজ করতে মানুষ ক্রমেই সড়ক ও গাড়ি নির্ভর হয়ে পড়ে। ফলাফল রাস্তায় তীব্র যানজট। সময়ের অপচয়।


অধুনা উন্নত বিশ্বের শহরগুলো মিশ্রভূমি ব্যবহারকে প্রাধান্যদিয়ে পরিকল্পনা করছে। গনপরিবহন পথচারী বান্ধব ফুটপাত, সামজিকভাবে দেখা করার স্থান, শিশুদের খেলার জায়গা,  ইনডোর/আউটডোর, স্টেডিয়ামসহ নানা সুযোগ সুবিধা সৃষ্টিকরার মতো পরিকল্পনা থাকছে তাদের নগর ভাবনায়। কোন কোন শহরে আইন করে নির্দিষ্ট পরিমান অনাবাসিক ভূমি কলকারখানা-সহ নানা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহারের কথা বলা হয়। পরিকল্পনায় পরস্পর পরিপূরক এমন ধরণের ভূমি ব্যবহার গুলোকে কাছাকাছি রেখে ভূমি ব্যবহার  পরিকল্পনা  প্রণয়নকরাকে উৎসাহিত করা হয়। এতে সড়ক ও গাড়ি ব্যবহারের উপর নির্ভরতা কমে এবং নগরকে পথচারী বান্ধব হিসাবে গড়ে তুলে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন করা হয়। বর্তমানে পথচারী বান্ধব শহর, জ্বালানী সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা, মিশ্রভূমি ব্যবহার ইত্যাদি স্মার্ট সিটির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আবাসিক এলাকায় অননুমোদিত ভবন বা ভূমি ব্যবহার বন্ধ হোক তা আমরা সবাই চাই কিন্তু আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী জনগণের কিছু সামাজিক ও নিত্যদিনের প্রয়োজন আছে যা ওই এলাকায় স্থানীয়ভাবেই মেটানো উচিত। আবাসিক এলাকায় পরস্পরের পরিপূরক ভূমি ব্যবহারকে কাছাকাছি রেখে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করাকে আধুনিক নগর পরিকল্পনায় উৎসাহিত করা হয়েছে।


সরকার প্রণিত বেসরকারী আবাসিক এলাকার ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা-২০০৪-তে এবং সেখানকার সর্বোচ্চ জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য-সেবা, উন্মুক্ত স্থান, বাসিন্দাদের কেনাকাটার স্থান ইত্যাদির সূচকসহ তফসিল দেয়া হয়েছে। সরকারি আবাসিক এলাকা এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোন কারণ নেই। বর্তমান বাস্তবতা ও আধুনিক নগর পরিকল্পনার ধারনা বিবেচনায় নিয়ে আবাসিক এলাকাগুলোর ভূমি ও ভবন ব্যবহারের জন্য প্রকৌশলী, স্থপতি ও নগরবিদদের পরামর্শ নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ময়মনসিংহ এখন বিভাগীয় শহর। দেশের চার প্রান্তরে সাথে এর রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা যা জনগনকে উৎসাহী করছে শহর কেন্দ্রিক আবাসন ব্যবস্থা গ্রহণের। ভালো মানের  কম্পিউটার সার্ভিস না থাকায় ময়মনসিংহে এখন ভাসমান জনগোষ্টি বাড়ছে। তাই যে কোন মূল্যে লোকে এ নগরীর  মধ্যেই নিজের ঠিকানা গড়তে সচেষ্ট হচ্ছে। তাই আবাসিক এলাকা (যেখানে কোন বাণিজ্যিক ব্যবহার নেই সেসব এলাকা) আধুনিক প্রযুক্তির যুগে অচল ধারণা। কেননা শুধু গাড়ি কেন্দ্রিক এলাকা নয়, হাঁটা দূরত্বে নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটার সুবিধা সম্বলিত এলাকাই এখন কাম্য। সেজন্য ভূমি ও দালানের মিশ্র পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলা এখনকার চরম বাস্তবতা। মিশ্র এলাকা একটি শহরের জন্য উত্তম। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য ও সেবা প্রাপ্তি। এসব সুবিধা বাসস্থানের খুব কাছাকাছি পাওয়া গেলে আমাদের সুবিধাগুলো নগর  পরিকল্পনায় সমন্বিত করার মাধ্যমে মানুষের জীবযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে তেমনি একটি আন্তরিক পরিবেশ বান্ধব শহর গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আমাদের দেশের নগরগুলোর অধিকাংশ এলাকা মিশ্র ব্যবহার ভিত্তিক।

এখানে খুব অল্প দূরত্বেই প্রায় সব নাগরিক সুবিধাদি পাওয়া যায়।শহরের কর্মকান্ডকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য জোন ভাগ করার প্রয়োজন আছে। তবে প্রতিটি জোনের  জন্য  কী কী সুবিধা থাকা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা কঠিন। তারপরও কিছু বিষয় ও উপাদান রয়েছে যেগুলো মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়। যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাজার, বিনোদন, কর্মসংস্থান, আবাসন, ইত্যাদি। প্রতিটি জোনে অল্প দূরত্বে এসব সুবিধা থাকলে যাতায়াতের চাহিদা কমবে। কমবে যানজট, কমবে জ্বালানী খরচ ও সময়ের অপচয়। তাই নগর পরিকল্পনায় বহুতল ভবন নির্মানের কোন বিকল্প নেই। যা নিশ্চিত করবে পরিপূর্ণ নাগরিক সুবিধা। একই ভবনে আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, বাজার, কর্মস্থল, বিনোদন ইত্যাদির সুযোগ সুবিধা থাকলে জনগণের যাতায়াতের চাহিদা কমবে। যা যানজট নিরসনের সাহায্য করবে এবং মানুষ অতিরিক্ত খরচের হাত থেকে মুক্তি পাবে।