আমাদের সর্বশেষ সংবাদ

নগরায়ন ও আগামীর ময়মনসিংহ

Apr 17, 2019
নগরায়ন ও আগামীর ময়মনসিংহ

নগরায়ন ও আগামীর ময়মনসিংহ
স্থপতি সজীব পাল
সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

‘ময়মনসিংহ’ জেলা ময়মনসিংহ বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। অবিভক্ত ভারত বর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে ১৭৮৭ সালের ১মে এই জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। আয়তনের দিক থেকে বৃহৎ জেলা গুলোর অন্যতম ‘ময়মনসিংহ’ ১৯৭০ এর পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলায় ভাগ হয়ে বর্তমানে ৪৩৬৩.৪৮ বর্গ কি.মি. এলাকায় সীমাবদ্ধ। ২০১১ সালের আদম শুমারি অনুসারে যার জনসংখ্যা ৫০,৪২০০০। বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরু ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পাশ্ববর্তী জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোণা জেলার সমন্বয়ে। পুরাতন বহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত এ অঞ্চল ‘শিক্ষা নগরী’ হিসেবে প্রসিদ্ধ।


ময়মনসিংহ জেলা থেকে ‘বিভাগ’ এ উন্নীত হওয়ায় এ অঞ্চলের গুরুত্ব বর্তমানে বেড়ে গেলেও রাজধানী ঢাকার সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বিগত দেড় দশক ধরেই ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। যার ফলে বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে জীবিকার চাহিদা। কর্মসংস্থান ও সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ ভিড় করছে রাজধানী লাগোয়া-এক সময়ের মফস্বল এ শহরটিতে। সংগত কারণেই আবাসনের যোগান হয়ে পড়ছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শহর বড় হতে শুধু করলেও তা জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে শহর বাড়ছে ভার্টিক্যালি অর্থাৎ উপরের দিকে। আবাসন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তৈরী হচ্ছে বহুতল ভবন তথা ফ্ল্যাট ও এপার্টমেন্ট। এছাড়া সাধারণ মানুষও যৌথ মালিকানায় তৈরি করছে সুউচ্চ অট্টালিকা।
বিভাগ সম্প্রসারণ ও প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হলেও তার বাস্তবায়ন যেমন সুদূরপ্রসারী তেমনি শহরের অভ্যন্তরীন আবাসন কাঠামো নিয়ন্ত্রনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখভালের জন্য পৃথক কোন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ না থাকায় ঘটছে অপরিকল্পিত ও এলোমেলো নগর উন্নয়ন। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি ময়মনসিংহ শহর হারাচ্ছে তার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শাশ্বতরূপ।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীর প্রধান অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ নগরায়ন সম্পর্কে তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, আমাদের দেশে নগরকে ঘিরে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু সে সব প্রকল্প সমূহ প্রকৌশলগতভাবে কতটা গ্রহনযোগ্য, কতটা টেকসই হবে তাতে নাগরিকদের কোন উপকারে আসবে বিনা, তা সাধারণত যাচাই করা হয় না। অর্থাৎ প্রকল্পগুলোতে জনগনকে সম্পৃক্ত করা হয় না। ময়মনসিংহের নগরায়ন নিয়ে তাই নতুন করে ভাবার এখনই সময়। শহরবাসীর চাহিদার কথা মাথায় রেখে শহর সম্প্রসারণ ও অভ্যন্তরীন প্ল্যানিং উভয় বিষয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়ে সামনে আগাতে হবে। আর এজন্য স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সাথে এগিয়ে আসতে হবে অভিজ্ঞ স্থপতি, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ ও আবাসন শিল্পে সংশ্লিষ্ঠ সকলকে। কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞরাই পারেন তাদের মেধা ও মননে আমাদের প্রাণপ্রিয় এ শহরকে বসবাসের উপযোগী একটি আর্দশ নগর হিসেবে গড়ে তুলতে।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর মত আলাদা ‘ইমারত নিমার্ণ বিধিমালা’ না থাকলেও বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা গুলোর মত ময়মনসিংহের ইমারত নির্মাণের নিয়মাবলী ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০০৬’ অনুযায়ী হওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোড মেনে সকল নির্মাণকার্য সম্পন্ন করা হয়। আর নকশা প্রণয়নের সময় স্থপতি ও প্রকৌশলীদেরও কোড সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত ও সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি সম্প্রতি নবগঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির বিভিন্ন ভবণের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতকর্তা অবলম্বন করা উচিৎ। একটি আবাসিক প্রকল্প-কোথায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, প্রকল্পের সামনের রাস্তার প্রশস্ততা কেমন, তার আশেপাশের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা যেমন- বিদুৎ, গ্যাস ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি যথাযত কিনা, সর্বোপরি পরিবেশগতভাবে প্রকল্পটি উক্ত এলাকায় উপযোগী কিনা তা বিবেচনায় রাখতে হবে। ভবনের স্ট্রাক্চারাল সেইফটি এবং অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাও দেখতে হবে। পুরাতন শহর হওয়ায় এখানকার ঐতিহ্যবাহী ভবনসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ ও জলাধার সংরক্ষণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


নগরায়ন বর্তমান সময়ের একটি অনিবার্য প্রক্রিয়া। নগর মানেই ইট, কাঠ আর পাথরের  যান্ত্রিক জীবন নয়। গড়ে ওঠা একটি নগর নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অপরিকল্পিত উন্নয়নে মানুষের মধ্যে কাড়ে অপরাধ প্রবণতা। একটি সুষ্ঠু-সুন্দর পরিকল্পিত নগর দক্ষ ও উন্নত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে বাসযোগ্য ও আদর্শ ময়মনসিংহ শহর তৈরিতে অভিজ্ঞ স্থপতি, প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ এবং নির্মাণ সংশ্লিষ্ঠ সকলের আতœনিয়োগের তাই এখনই সময়।